শুভ্র শিশির: চীনের পঞ্চদশ সৌরপদ

বাংলা ১৩৩৬ সনের ৭ই পৌষ শান্তিনিকেতনে বসে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন:
বহু দিন ধরে’ বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশির বিন্দু।।
শিশির হলো কোনো শীতল বস্তুর ওপর জলীয় বাষ্প জমা হয়ে সৃষ্ট গোলাকার বিন্দুবিশেষ। একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় বায়ু একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত জলীয় বাষ্প ধারণ করতে পারে। তাপমাত্রা বাড়লে বায়ুর বাষ্প-ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, তাপমাত্রা কমলে ধারণক্ষমতাও হ্রাস পায়। সাধারণত সন্ধ্যার পরে তাপমাত্রা কমতে থাকে এবং বাতাস জলীয় বাষ্প দ্বারা সম্পৃক্ত হয়। তাপমাত্রা কমতে কমতে একটা নির্দিষ্ট সীমায় পৌঁছালে (যাকে ইংরেজিতে বলে ‘ডিউ পয়েন্ট’), বায়ু তখন আর জলীয় বাষ্প ধরে রাখতে পারে না এবং তা শীতল বস্তুর ওপর পানির কণা হিসেবে জমা হয়। এ পানির গোলাকার বিন্দু-ই বিশ্বকবির ‘শিশির বিন্দু’।
এই শিশির পরিমাপও করা যায়। শিশির পরিমাপক যন্ত্রের নাম ড্রসোমিটার। গ্রিক শব্দ drosos (শিশির) ও metron (পরিমাপ) থেকে ‘ড্রসোমিটার’ শব্দটির উৎপত্তি। তাত্ত্বিকভাবে এক রাতে সর্বোচ্চ ০.৮ মিলিমিটার পর্যন্ত শিশির পড়তে পারে। তবে বাস্তবে খুব কম ক্ষেত্রেই ০.৫ মিলিমিটারের সীমা অতিক্রম করে।
শিশির থেকে পানি সংগ্রহ করা কঠিন কাজ। বড় স্কেলে কাজটা আরও কঠিন। তবে পৃথিবীর যেসব স্থানে বৃষ্টি ও কুয়াশা থেকে পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যায় না, সেসব স্থানে শিশির থেকে পানি সংগ্রহের কার্যকর পদ্ধতি আবিষ্কারে কাজ করে যাচ্ছে ‘শিশির সদ্ব্যবহারের জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থা’।
এই সংস্থার সাথে সহযোগিতার ভিত্তিতে, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট আহমেদাবাদ (আইআইএমএ) গুজরাটের কুচ জেলায় বড় স্কেলে শিশির সংগ্রহের ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। অক্টোবর থেকে মে পর্যন্ত, শিশিরের মৌসুমে, এই ব্যবস্থায় গড়ে প্রতি রাতে ২০০ লিটার পর্যন্ত শিশির-পানি সংগ্রহ করা যায়। আইআইএমএ প্রমাণ করেছে, উপকূলীয় শুষ্ক এলাকাগুলোতে শিশির হতে পারে বিশুদ্ধ পানির বিকল্প উৎস।
শিশির সম্পর্কে আমাদের আধুনিক জ্ঞানের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই প্রাচীন আমলের জ্ঞানের পার্থক্য আছে। খ্রিস্টের জন্মের আড়াইশ বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিল De Mundo(On the Universe)শীর্ষক গ্রন্থটি। গ্রন্থটির রচয়িতা কে, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। অনেকে অনেকের নাম নিয়েছেন। মধ্যযুগে সবচেয়ে বেশি যার নাম লেখক হিসেবে এসেছে, তিনি গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল। তবে, আধুনিক যুগে এসে মোটামুটি সবাই একমত যে, গ্রন্থের লেখক অজ্ঞাত। তবে, লেখক যে-ই হোক, সম্ভবত এটি সবচেয়ে প্রাচীন গ্রন্থ, যেটিতে শিশিরের কথা উল্লেখ আছে। গ্রন্থে বলা হয়েছে: ‘শিশির হচ্ছে সূক্ষ্ম তরল পদার্থ, যা পরিষ্কার আকাশ থেকে নিচে ঝরে পড়ে।’
এদিকে, গ্রিক পুরাণ অনুসারে, এরসা ছিলেন শিশির-দেবী। তিনি দেবরাজ জিউস ও চন্দ্রদেবীর কন্যা। যখন এরসার আন্টি ও ঊষাদেবী এওস কাঁদতেন, তখন শিশির পড়তো। তিনি কাঁদতেন ছেলে মেমনের মৃত্যুশোকে। মেমনন ট্রয়ের যুদ্ধে বিখ্যাত বীর অ্যাকিলিসের (Achilles) হাতে প্রাণ হারান। মৃত্যুর পর মেমনন একসময় অমরত্ব লাভ করেন। কিন্তু মায়ের কান্না কখনও থামেনি, নিয়মিত বিরতিতে শিশির হয়ে ঝরেছে।
বিভিন্ন ধর্মেও আছে শিশিরের সদর্প উপস্থিতি। হিব্রুতে ‘তাল’ মানে শিশির। ইহুদি ধর্মে ‘পাসওভার’র (ফেরআউনের কবল থেকে বনি-ইসরাইলের রক্ষা পাওয়ার ঘটনা স্মরণে আয়োজিত গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় অনুষ্ঠান) প্রথম দিন শিশিরের জন্য প্রার্থনা করা হয়। ডিসেম্বর ও পাসওভারের মাঝামাঝি সময়ও বৃষ্টির সঙ্গে শিশিরের জন্য প্রার্থনা করে ইহুদিরা। বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টেও শিশিরের উল্লেখ আছে।
চীনা পুরাণে শিশিরের উল্লেখ আছে কি না, জানি না। তবে, প্রাচীন চীনে উদ্ভূত সৌরপদের একটির নাম ঠিকই রাখা হয়েছে শিশিরের নামে। সবাই জানেন, চীনের চান্দ্রপঞ্জিকা অনুসারে বছরকে ভাগ করা হয় ২৪টি সৌরপদে (solar terms)। প্রাচীন চীনে হলুদ নদীর অববাহিকায় এই ২৪ সৌরপদের উৎপত্তি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই ২৪ সৌরপদ ‘চীনের পঞ্চম মহান আবিষ্কার’ (Fifth Great Invention of China) হিসেবে স্বীকৃত। ইউনেস্কোও একে মানবজাতির অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
প্রতিটি সৌরপদের আছে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য। চীনে হাজার হাজার বছর আগে এই সৌরপদ-ব্যবস্থার উৎপত্তি। তখন থেকেই চীনারা সৌরপদ অনুসারে নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে কৃষিকাজ আঞ্জাম দিয়ে আসছে। বছরের কোন সৌরপদে আবহাওয়া কেমন থাকবে—তা নামগুলো দেখলেই বোঝা যায়।
সৌরপদ অনুসারে চীনারা তাদের খাওয়া-দাওয়ায়ও পরিবর্তন আনে, পরিবর্তন আনে পোশাক-আশাকে। আজ (৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২) তেমনি একটি সৌরপদের প্রথম দিন। এটি চীনা চান্দ্রপঞ্জিকার পঞ্চদশ সৌরপদ। এর নাম ‘পাইলু’। চীনা ভাষায় ‘পাই’ মানে ‘সাদা’ বা ‘শুভ্র’ এবং ‘লু’ মানে ‘শিশির’। পাইলু সৌরপদের ব্যাপ্তিকাল ৭ সেপ্টেম্বর থেকে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।
পাইলু হচ্ছে ঠান্ডা ঠান্ডা শরতের প্রকৃত শুরুর ইঙ্গিত। এসময় তাপমাত্রা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। কমতে কমতে যখন তাপমাত্রা ‘ডিউ পয়েন্টে’ নেমে আসে, তখন বাতাসের বাষ্প ঘনীভূত হয়ে শুভ্র শিশির সৃষ্টি করে। রাতে সেসব শিশির জমে ঘাসের ডগায় বা গাছের কাণ্ডে ও পাতায় বা ফুলে। সকালের সূর্যের আলোয় এসব শিশির হয়ে ওঠে স্পষ্ট, নিখুঁত শুভ্র ও নান্দনিক। যত দিন যায়, শিশিরের পরিমাণও তত বাড়তে থাকে।
আগেই বলেছি, প্রতিটি সৌরপদে চীনাদের খাওয়া-দাওয়ায় কমবেশি পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। পাইলু ব্যতিক্রম নয়। এসময় চীনারা বেশি বেশি আঙুর খায়। পাইলু সৌরপদে বিভিন্ন ধরনের আঙুর পাওয়া যায় এন্তার। অবশ্য, সুলভ বলেই এসময় চীনারা বেশি বেশি আঙুর খায়, তা নয়। চীনা ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাবিদ্যা অনুসারে, শরতের আঙুর হজমে সহায়তা করে এবং শরীর থেকে দূষিত পদার্থ বের করে দেয়।
পাইলুতে চীনে বড়, মিষ্টি ও সুস্বাদু লঙ্গন বা কাঠলিচু পাওয়া যায়। পূর্ব চীনের ফুচিয়ান প্রদেশের ফুচৌ এলাকায় একটি কথা প্রচলিত আছে: ‘পাইলু সৌরপদের প্রথম দিনে লঙ্গন খেলে শরীর তাজা থাকে। এসময় একটি লঙ্গন থেকে একটি ডিমের সমান পুষ্টি পাওয়া যায়।’ এ দাবি বাড়াবাড়ি মনে হলেও বাস্তবে লঙ্গন প্লিহা সুস্থ রাখে, রক্তে পুষ্টি জোগায়, নার্ভ শান্ত রাখে, এবং ত্বকের সৌন্দর্য বাড়ায়।
চীন ওয়াইনের দেশ। চীনা ভাষায় ওয়াইনকে বলে চিওউ। চীনাদের খাবার টেবিল চিওউ ছাড়া অসম্পূর্ণ। প্রায় ৬ হাজার বছর আগে থেকেই চীনারা নানান ধরনের ওয়াইন তৈরি ও ব্যবহার করে আসছে। দেবতাদের পূজায়ও চীনারা ওয়াইন ব্যবহার করে। আধুনিক চীনে তৈরি হয় নানান ধরনের ওয়াইন। নানচিংয়ের একশ্রেণির বাসিন্দা, যারা চ্যচিয়াং প্রদেশ থেকে আসা বা চিয়াংসুর দক্ষিণাঞ্চলের লোক, পাইলু সৌরপদে ‘শুভ্র শিশির ওয়াইন’ তৈরি করেন। এটি তৈরিতে সাধারণত আঠালো ভাত ও এক ধরনের বিশেষ শালগম ব্যবহার করা হয়।
অনেক চীনা বিশ্বাস করেন যে, পাইলু সৌরপদে সবচেয়ে ভালো খাবার হচ্ছে মিষ্টি আলু। অতীতে চীনা কৃষকরা পাইলু’র প্রথম দিন নিয়ম করে মিষ্টি আলু খেতেন। চীনা ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাবিদ্যা অনুসারে, মিষ্টি আলু প্লিহা সুস্থ রাখে এবং এটি ক্যানসারের বিরুদ্ধে এক নম্বর সবজি। মিষ্টি আলু আয়ু বাড়ায় ও রোগ-বালাই থেকে মানুষকে বাঁচায় বলেও বিশ্বাস করা হয়।
পূর্ব চীনের চ্যচিয়াং প্রদেশের ওয়েনচৌ এলাকার মানুষ একটি বিশেষ প্রথা মেনে চলে। পাইলু সৌরপদের প্রথম দিন তারা ১০ পদের ভেষজ ওষুধ জড়ো করে। প্রতিটি ওষুধের নামের একটি অংশ হচ্ছে চীনা শব্দ ‘পাই’, যার অর্থ ‘সাদা’। এলাকার মানুষ বিশ্বাস করে, এই দশ পদের ওষুধ এবং মুরগি বা হাঁসের মাংস মিশিয়ে স্টু রান্না করে খেলে বাত ভালো হয়ে যায়।
পাইলু সৌরপদকে কেন্দ্র করে শিশু-কিশোরদের জন্যও প্রথা আছে। পূর্ব চীনের শানতুং প্রদেশের থানছ্যং কাউন্টির শিশুরা এ সৌরপদের প্রথম দিনে কাঠের তৈরি সোয়ালো পাখির আদলের একধরনের খেলনা গাড়ি দিয়ে খেলে। কাউন্টির প্রতিটি পরিবারে এমন খেলনা গাড়ি তৈরি হয়। পরিবারের বড় সদস্যরা নিজেদের হাতে কাঠ কেটে গাড়ি তৈরি করেন। শিশুরা মনের আনন্দে তা হাতে ঠেলে ঠেলে দৌড়ায়। এলাকার লোকজন বিশ্বাস করেন, এতে শিশুরা ঠান্ডা থেকে বাঁচবে এবং আসন্ন শীতের জন্য তাদের শরীর ভালোভাবে তৈরি হবে।
চীনের প্রাচীনতম রাজবংশের নাম ‘সিয়া’ (Xia)। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সম্রাট তা ইয়ু। তিনি ‘ইয়ু দ্য গ্রেট’ নামেও পরিচিত। কথিত আছে, তিনি বন্যা নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি আবিষ্কার করে জনগণকে বন্যার কবল থেকে বাঁচিয়েছিলেন। অনেক চীনার কাছে তিনি ম্যান-গড। পাইলু সৌরপদের প্রথম দিনে পূর্ব চীনের থাইহু হ্রদ এলাকার লোকজন তা ইয়ু’র পূজা করেন।
চীন চায়ের দেশ; চায়ের জন্মস্থান। কথিত আছে, পাঁচ হাজার বছর আগে তথা প্রস্তরযুগে, চীনের তৎকালীন সম্রাট শেন নোং শি ঘটনাচক্রে চা আবিষ্কার করেন। সেই থেকে চা-পান চীনা সংস্কৃতির অংশ। তারা চা দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করেন, চা দিয়ে বন্ধুত্ব গড়েন, চা দিয়ে নিজেদের স্বাস্থ্যের যত্ন নেন।
এদেশে লোংচিং, থিয়ে কুয়ান ইন, পুআর, কুংফু ইত্যাদি নামের বিখ্যাত চা পাওয়া যায়। ‘শুভ্র শিশির চা’ (হোয়াইট ডিউ টি) এসব চায়ের মতো অতো বিখ্যাত নয়। কিন্তু চিয়াংসু প্রদেশের নানচিংয়ের চাপায়ীরা পাইলু সৌরপদে এই চা পছন্দ করেন। এই চা বসন্তের বা গ্রীষ্মের চায়ের চেয়ে ভিন্ন। পাইলু সৌরপদে বাগান থেকে তোলা চা অতিরিক্ত সুগন্ধযুক্তও বটে।
আমি চীনে হরেক রকমের চায়ের স্বাদ নিয়েছি। তবে এখনও ‘শুভ্র শিশির চা’ বা ‘হোয়াইট ডিউ টি’ চেখে দেখার সুযোগ পাইনি। সুযোগের অপেক্ষায় আছি। আশা করি, একদিন পেয়ে যাবো।
লেখক: বার্তাসম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি), বেইজিং।
alimulh@yahoo.com